যে মানুষটি বাংলা সিনেমার কিংবদন্তী, যার প্রজ্ঞা বৈদগ্ধ আভিজাত্য সেইসঙ্গে সারল্যে ভরা হাসিমুখ বাঙালির প্রজন্মের পর প্রজন্ম মনে থাকবে সেই মানুষটির জীবনেও ছিল অসংখ্য না পারা৷ যে হাসি দেখলে মনে হত সেই চেহারা, অমন সুন্দির কন্ঠস্বর,অভিনয় প্রতিভা যার সাফল্য তার কাছে সময়ের অপেক্ষা মাত্র৷ আসলে ঘটনাটা কিন্তু তা নয়৷
আর পাঁচটা সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলের মতই একসময় চাকরিপ্রার্থী ছিলেন সৌমিত্র৷ আকাশবাণীতে একটিই মাত্র শূন্য পদ৷ তার জন্য একগুচ্ছ দাবিদার৷ সেই দাবিদারদের সঙ্গে পরীক্ষা দিয়েছেন৷ তাঁরই সঙ্গে পরীক্ষা দিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়৷ কিন্তু শিকে ছিঁড়ল না৷ চাকরির পরীক্ষায় প্রথম হলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়৷ শুন্যপদ একটিই৷ তাই আশা নেই৷ সৌমিত্রবাবু পরীক্ষায় হয়েছেন দ্বিতীয়। কিন্তু আচমকাই এল ডাক বাংলা ছবিতে। না সৌমিত্র’র নয়, অনিল চট্টোপাধ্যায় এর৷ তাই চাকরি না নিয়ে অনিল বাবু চলে গেলেন৷ সেই জায়গায় চাকরি করতে শুরু করলেন সৌমিত্রবাবু।
শিশির ভাদুড়ি’র অভিনয় দেখে ঠিক করলেন আর চাকরি নয়৷ এবার অভিনয় হবে তার জীবন জীবিকা৷ কিন্তু শুধু চাকরি নয়, অভিনয়ের ক্ষেত্রেও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কেও অডিশন দিতে হয়েছিল৷ আর প্রথম চেষ্টাতেই ব্যর্থতা৷ জীবনের প্রথম স্ক্রিনটেস্টে বাতিল হয়ে যান সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ১৯৫৭ সালে কার্তিক চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘নীলাচলে মহাপ্রভু’ চলচ্চিত্রের জন্য স্ক্রিনটেস্ট দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাকে বাদ দেওয়া হয়৷ তারপর এই ছবিতে চৈতন্যদেবের ভূমিকায় অভিনয় করেন অসীম কুমার।
চা’ওলা পড়ায় হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে
সিটি কলেজে পড়ার সময় সাহিত্যিক এবং অধ্যাপক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের পরামর্শে থিয়েটারে আসেন৷ থিয়েটারই তার অভিনয়ের মূল ভিত শক্ত করে গড়ে দিয়েছিল৷ খ্যাতি যশ সত্ত্বেও তিনি ছিলেন অভিনয়ের একনিষ্ঠ ছাত্র৷ তাই অভিনয়ের ছোট্ট খুঁটিনাটিও তিনি চাইতেন পারফেক্ট হোক৷ ‘চারুলতা’ ছবিতে হাতের লেখার বেশ কয়েকটি শট থাকবে বললেন সত্যজিৎ রায়। কিন্তু সৌমিত্র’র হাতের লেখা নয়, ঊনবিংশ শতকের হাতের লেখার তিনটি স্যাম্পেল দিলেন সত্যজিৎ রায়। তিন মাস কেবল হাতের লেখা অভ্যাস করলেন সৌমিত্র৷ শুটিং শেষে শেখা হাতের লেখা ভুলে নিজের হাতের লেখায় ফিরতে সময় লেগেছিল দীর্ঘ ছয় মাস৷
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মানেই বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা৷ কিন্তু কখনো কখনো কাজের ক্ষেত্রে তার এই বুদ্ধিদীপ্ততা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ গুপি বাঘা ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করতে পারেন নি৷ কারণ তপেন চট্টোপাধ্যায় এর চেহারায় যে গ্রাম্যতা ছিল তা গুপির চরিত্রের জন্য যথাযথ ছিল। এমন একটা চরিত্রে নিজে সুযোগ পান নি বলে আক্ষেপ ছিল না৷ বরং সিনেমার স্বার্থে চরিত্রের স্বার্থে তপেন চট্টোপাধ্যায় সঠিক নির্বাচন সেকথা প্রকাশ্যেই স্বীকার করেছেন৷
সিনেমার নায়ক হলেও ব্যক্তিজীবনে ছিলেন সাধারণ৷ তাই ছেলে মেয়েকে জন্মদিনে উপহার দিতেন কবিতা৷ সংস্কৃতির বহমানতা ধরে রাখাই ছিল জীবনের মূল লক্ষ্য৷ আজীবন অভিনয়ের ছাত্র একনিষ্ঠ সংস্কৃতির কর্মী ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।